একটি প্রাচীন জলাশয়ের আত্মকথা রচনা [সঙ্গে PDF]

জলাশয় হল ভারতীয় উপমহাদেশের সাবেকি সমাজজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আধুনিক সভ্যতার প্রসারের কালে জলাশয় এর সঙ্গে শহুরে মানুষের পরিচিতি অনেক কমে এসেছে। এমনকি গ্রামের দিকে ও অসংখ্য আভিজাত্যপূর্ণ জলাশয় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। এরকম বহু পরিত্যক্ত জলাশয়ের হয়তো সমৃদ্ধ কোন ইতিহাস রয়েছে। তেমনি কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বাংলার কোন একটি প্রবীণ জলাশয়ের ইতিহাসকে আরো একবার ফিরে দেখার উদ্দেশ্যে একটি প্রাচীন জলাশয়ের আত্মকথা প্রতিবেদনটির উপস্থাপনা।

একটি প্রাচীন জলাশয়ের আত্মকথা রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

পৃথিবীতে যে কোন প্রাণীর জীবন রক্ষার তাগিদে যে উপাদানগুলি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল জল। জল ছাড়া কি প্রাণী, কি উদ্ভিদ কেউই বাঁচতে পারে না। সে কারণেই জলের অপর নাম হল জীবন। আর সেই জলকে যে মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনের জন্য ধারণ করে রাখে, তার নাম জলাশয়। জলাশয় ছাড়াসাধারণ মানুষের কাছে জল সার্থকভাবে ব্যবহার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে না।

তাই জীবন রক্ষার জন্য জল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জলাশয়ও গুরুত্বপূর্ণ। নিজের এই জীর্ণ বার্ধক্যের কালে আমাদের গুরুত্বকে আরো একবার সকলের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই হয়তো এই আত্ম স্তুতি। হ্যাঁ, আমি একটি প্রাচীন জলাশয়, যে নিজের দীর্ঘজীবনের অসংখ্য পৃষ্ঠা পেরিয়ে এই জরাজীর্ণ নিঃসঙ্গ বার্ধক্যে উপনীত হয়ে নিজের আত্মকথা বলার উদ্দেশ্যে এই উপস্থাপনার অবতারণা করছে। 

আমার জন্মের কথা:

ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি, বয়সে আমি অতি প্রাচীন। আমার জন্ম হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে। এখনো মনে আছে সেই দিনটির কথা, যেদিন জমিদার রমাকৃষ্ণ রায় নিজের হাতে ঘট পুজো করে আমার উদ্বোধন করলেন। আমার জন্মদাতা  রমাকৃষ্ণ রায় ছিলেন আমার এই গ্রাম সহ মোট 35 টি গ্রামের জমিদার। তিনি এখানে তার কুঠিবাড়িতে আমার পত্তন করার আগে অবধি এই অঞ্চল ছিল নিচু জঙ্গল আর পচা ডোবায় পূর্ণ।

জমিদারবাবু এখানে নিজের কুঠিবাড়ি নির্মাণ করে বাড়ির পিছনের দিকে জঙ্গল পরিষ্কার করে মাটি কেটে তৈরি করলেন আমায়। তখন আমার চারপাশ বাধানো ছিল লাল রঙে। আমার চারদিকে ছিল চারটি ঘাট। লোকে আমায় নাম দিয়েছিল কুঠিবাড়ির পুকুর বলে। জমিদারবাবু একদিন বেশকিছু জেলেদের নিয়ে আমার জলের মধ্যে ছেড়ে দিলেন নানা প্রকার মাছ। তারা আমার বুকের অন্তঃস্থলে দিবারাত্র খেলা করে বেড়াতো। 

ইতিহাসে আমি:

বয়সে এতো প্রবীণ হওয়ার কারণে ইতিহাসের অভিজ্ঞতাও আমার কম নয়। আমি তো কথা বলতে পারিনা, তাই সব কিছুর নীরব দর্শক হয়ে মনের স্মৃতির পাতায় লিখে রাখি সেই সব অভিজ্ঞতা। সেই জন্ম থেকে এই জমিদার বাড়ির চারপাশে কত ঘটনা দেখেছি আমি। কখনো দেখেছি যারা জমিদারের কাছে এসে খাজনা মকুবের জন্য কান্নাকাটি করছে।

কখনোবা দেখেছি জমিদার মশাই আমার বাঁধানো পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে বিচার করছেন স্থানীয় অপরাধীদের। প্রতিবছর বাসন্তী পূজার দিনে জমিদার মশাইকে কল্পতরু হতে দেখেছি। তারও বহুকাল পরে এই বাড়িতে আসতে দেখেছি ভারতবর্ষের নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়কে। তিনি আমার জলে তার পা ধুয়েছেন; তার চরণস্পর্শে সিক্ত হয়ে আমার শরীর হয়েছে পবিত্র। 

একটি স্মরণীয় ঘটনা:

এই সুদীর্ঘ জীবনে এক জমিদার বাড়ির জলাশয় হবার কারণে বিভিন্ন স্মরণীয় অভিজ্ঞতার সংখ্যা আমার নেহাত কম নয়। এই অভিজ্ঞতার ঝুলি একবার খুললে বন্ধ করা মুশকিল। তবে আমার জীবনের সবথেকে স্মরণীয় ঘটনা যেটি, সেটি আনন্দের নয়, বরং মর্মান্তিক ও অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। সেটা ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ।

বাংলার চারদিকে তখন জ্বলছে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদী আগুন। দিকে দিকে বিপ্লবীরা নরমপন্থী আলাপ-আলোচনায় আস্থা হারিয়ে বেছে নিচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ। ব্রিটিশ সরকার কঠোর হাতে দমন করছে সেই সব বিপ্লবীদের। এমনই এক দল স্থানীয় যুবক বুকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বাসা বেঁধেছিল এই জমিদার কুঠিবাড়ির পিছন দিকে।  ততদিনে বিপ্লবীদের ভয়ে জমিদার বাড়ি থেকে সব লোকজন পালিয়েছে।

হঠাৎ একদিন রাতের বেলা অতর্কিতে ব্রিটিশ পুলিশ হানা দিল এই বাড়িতে। সকল বিপ্লবী যুবকদের ধরে সারিতে দাঁড় করানো হলো আমার পাড় ঘেঁষে। তারপর হঠাৎ ভীষণ আওয়াজ করে একসাথে অনেকগুলো গুলির শব্দ হলো। নিরীহ সেসব যুবকদের রক্তাক্ত লাশ এসে পড়ল আমার জলে। আমার টলটলে মোলায়েম জলে লাল রঙের ছোঁয়া লাগলো।

আমার সেকাল-একাল:

সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে আর কখনো জমিদারেরা এই বাড়িতে ফিরে আসেনি। স্থানীয় মানুষ বলতো এই কুঠিবাড়িতে কান পাতলে আজ নাকি বিপ্লবীদের আর্তনাদ শোনা যায়। সেই ভয়ে কেউ কখনো আর এই বাড়িতে আসে না। তাই একাকিত্বে অযত্নে আমার চারপাশে আজ জমেছে শ্যাওলার প্রলেপ, ঘাট গুলি সব ভেঙে পড়েছে।

শুধু মাঝে মাঝে কয়েকটি থাম মাথা তুলে নিজেদের ইতিহাসের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আমার চারপাশ আবার গ্রাস করেছে জঙ্গল ও আগাছা। যে জলে একসময় চাঁদের ছায়া পড়তো, সেই জল এখন কালো নোংরা। জমিদার রমাকৃষ্ণ রায়ের হাতে ছাড়া মাছেদের বংশধর এখনো আমার জলের ভিতর বাস করে। আমার মতই প্রবীণ তাদের বয়স, জীর্ণ তাদের শরীর। 

উপসংহার:

এই দীর্ঘ জীবন থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি সময়ের সাথে পৃথিবীর যেকোনো জিনিস কে বদলে যেতে হয়। এ পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়, তাই পরিবর্তনই একমাত্র নিয়ম। সময়ের সাথে সেই নিয়ম মেনে পরিবর্তিত হয়েছি আমিও। বয়সের ভারে, অযত্নে-অবহেলায় জীর্ণ হয়েছি; দীর্ঘ জনহীনতায় নিঃসঙ্গ হয়েছি।

তবুও আমি নিঃস্ব নই। আমার কাছে আছে সুদীর্ঘ সময়ের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাই আমার পরম সম্পদ, একাত্ম অহংকার। তাই যতদিন বেঁচে থাকব, এই অহংকার বুকে নিয়ে দীর্ঘসময়ের মূর্তিমান ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো এই জনহীন কুঠি বাড়িতে।


উপরিউক্ত প্রতিবেদনটিতে আমরা একটি প্রাচীন জলাশয়ের আত্মকথাকে যথাসম্ভব যথাযথ ও বিশ্লেষণাত্মক ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশাকরি আমাদের এই প্রচেষ্টা আপনাদের ভাল লেগেছে এবং ফলপ্রসূ বলে মনে হয়েছে।

এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন রচনা পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর সেই রচনাটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন