উদ্দেশ্য ও বিধেয় কাকে বলে? প্রকারভেদ ও উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনা [PDF সহ]

উদ্দেশ্য এবং বিধেয় হলো বাংলা ব্যাকরণে বাক্য গঠনের সম্ভবত সবচেয়ে অপরিহার্য একটি অংশ। কোন বাক্যকে ব্যাকরণের মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করতে গেলে সর্বপ্রথম বাক্যটি থেকে উদ্দেশ্য এবং বিধেয় অংশকে আলাদা করতে হয়। তাই বাংলা ব্যাকরণে বাক্যকে বোঝার প্রয়োজনে সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য এবং বিধেয়র স্বরূপ বোঝা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য নিয়েই আজ আমরা বিশেষ করে বাক্যের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা মূলক একটি প্রতিবেদনের উপস্থাপনা করতে চলেছি।

উদ্দেশ্য ও বিধেয় বৈশিষ্ট্য চিত্র

উদ্দেশ্য এবং বিধেয় সম্পর্কে বোঝার জন্য প্রথমে বাংলা ভাষায় বাক্যের গঠন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। একটি বাক্য হলো মানুষের মনোভাবের অর্থযুক্ত প্রকাশক পদ সমুচ্চয়। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, কোন ভাষায় যে উক্তির সার্থকতা আছে এবং গঠনের দিক থেকে যাহা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেরূপ উক্তিকে ব্যাকরণে বাক্য বলে। বাংলা বাক্য সাধারণভাবে উদ্দেশ্য-বিধেয়-ক্রিয়া: এই কাঠামো দ্বারা গঠিত হয়। তবে এই কাঠামো ছাড়াও বাক্য নির্মাণের প্রধান তিনটি শর্ত বর্তমান। 

তারা হলো- ১) যোগ্যতা; ২) আকাঙ্ক্ষা; ৩) আসক্তি।

এই শর্তগুলি দ্বারা বাক্য সার্থকভাবে হয়ে ওঠে ভাষার একক। এই একক এর মধ্যে প্রধান অংশগুলো উদ্দেশ্য ও বিধেয়। 

উদ্দেশ্য কাকে বলে?

একটি বাক্যে যার সম্পর্কে কিংবা যাকে কেন্দ্র করে কিছু বলা হয় তাকে সেই বাক্যের উদ্দেশ্য বলে। ইংরেজি ভাষায় একে বলে subject. যেমন, রবীন্দ্রনাথ রাখি বন্ধন প্রচলন করেন। এই বাক্যটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তাই রবীন্দ্রনাথ এই বাক্যের উদ্দেশ্য। 

বিধেয় কাকে বলে?

ইংরেজি ভাষায় predicate নামে প্রচলিত যে বাক্যাংশে উদ্দেশ্যের গুনাগুন সম্পর্কে কিছু বলা হয় তাকে বিধেয় বলে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ রাখি বন্ধন উৎসব প্রচলন করেন। এই বাক্যটিতে রাখিবন্ধন উৎসব প্রচলন করেন অংশটি হলো বিধেয়।

দ্রষ্টব্য:

১) উদ্দেশ্য এবং বিধেয় এই প্রাথমিক আলোচনা পর্বে মনে রাখা প্রয়োজন, বাক্যের সাধারণত উদ্দেশ্য আগে এবং বিধেয় পরে বসে। তবে কখনো কখনো এর ব্যাতিক্রম ঘটতে পারে। যেমন, একশো ভাই ও এক বোনের মধ্যে দুর্যোধন বড়। কিংবা কোনো কথাই বলব না আজ আমি

২) বাক্যে উদ্দেশ্য ও বিধেয় অংশ উহ্য থাকতে পারে।

যেমন: আজকে কি যাবে? (এখানে বাক্যটির উদ্দেশ্য তুমি উহ্য)

আজই তো তোমার আসার কথা। (বাক্যটির বিধেয় আছে বা ছিল এখানে লুপ্ত)

উদ্দেশ্যর প্রকারভেদ:

বিশেষ্য বা বিশেষ্য স্থানীয় অন্যান্য পদ বা পদসহযোগে গঠিত বাক্যাংশও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে।

যেমন: সৎ লোকেরা এর প্রকৃত সুখী।- এই বাক্যে বিশেষ্য রূপে ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষণ

মিথ্যা বলা খুবই অন্যায়। এটি একটি ক্রিয়াজাত বাক্যাংশ। 

একটিমাত্র পদবিশিষ্ট কর্তৃপদকে সরল উদ্দেশ্য বলে। এবং উদ্দেশ্য সঙ্গে বিশেষনাদি যুক্ত থাকলে তাকে সম্প্রসারিত উদ্দেশ্য বলে।

উদ্দেশ্যর সম্প্রসারক:

বাক্যের মূল উদ্দেশ্যর পরিচায়ক পদ বা পদগুলোকে উদ্দেশ্যের সম্প্রসারক পদ বলে। প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্যর বিশেষণ প্রভৃতি যেসব শব্দ উদ্দেশ্য সঙ্গে (সাধারণত পূর্বে) যুক্ত হয়ে তার অর্থ কে বিশেষভাবে পরিস্ফুট বা বিশেষিত করে তাকে উদ্দেশ্যের সম্প্রসারক বলা হয়। 

উদাহরণসমূহ:

১) বিশেষণ যোগে- কুখ্যাত দস্যুদল ধরা পড়েছে। 

২) সম্বন্ধে যোগে- রমেনের ভাই এসেছে। 

৩) সমর্থক বাক্যাংশ যোগে- যারা অত্যন্ত পরিশ্রমী তারাই উন্নতি করে।

৪) অসমাপিকা ক্রিয়া বিশেষণ যোগে- চাটুকার পরিবৃত হয়েই রাজা থাকেন।

৫) বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে- যার কথা তোমরা বলে থাকো, তিনি এসেছেন।

বিধেয়র সম্প্রসারক:

মূল বিধেয়র পরিচায়ক পদ বা পদগুলোকে সাধারণভাবে বিধেয়র সম্প্রসারক পদ বলা হয়। কখনো কখনো বিধেয়র সম্প্রসারক উদ্দেশ্য আগেও এসে বসে।  যেমন: প্রচন্ড শব্দে ডালিমের মনসংযোগ ছিন্ন হল। বিধেয় বিশেষণকে ইংরেজি ভাষায় বাক্যের প্রথমে বসানোর রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই একই নিয়ম অনুসরণ করে কখনো কখনো বাংলা ভাষাতেও এর ভিত্তিতে বাক্য গঠিত হয়। যেমন: ধন্য সেই মা যার সন্তান ক্ষুদিরাম। প্রকৃতপক্ষে বিধেয়র অর্থ পরিস্ফুট করে প্রকাশ করার জন্য ক্রিয়ার যে বিশেষণ ইত্যাদি বিধেয়র সঙ্গে যুক্ত হয়, তাকে বিধেয়র সম্প্রসারক পথ বলে।

উদাহরণসমূহ:

১) ক্রিয়া-বিশেষণ যোগে: ঘোড়া দ্রুত চলে।

২) ক্রিয়া বিশেষণীয় যোগে: চিতাবাঘ অতি দ্রুত চলতে পারে।

৩) কারকাদি যোগে: ভুবনের ঘাটে ঘাটে ভাসিছে।

৪) ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে: তিনি যেভাবেই হোক আসবেন।

৫) বিধেয় বিশেষণ যোগে: ইনি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। 

উদ্দেশ্যর প্রসারণ মূলক উদাহরণ:

১।
ক) মেয়েটি নাচে।

খ) ছোট্ট মেয়েটি নাচে।

গ) বেঁটেখাটো ছোট্ট মেয়েটি নাচে।

ঘ) নীল রঙের জামা পড়ে বেঁটেখাটো ছোট্ট মেয়েটি নাচে।

২।
ক) রতন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

খ) দশম শ্রেণীর ছাত্র রতন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

গ) কুসুমপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র রতন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

ঘ) সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত কুসুমপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র রতন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

উপরে আলোচ্য উদাহরণ গুলিতে বিশেষণ পদগুলি ক্রমান্বয়ে উদ্দেশ্য পদের পূর্বে যুক্ত হয়ে উদ্দেশ্য পদের পূর্ণ পরিচয় ব্যক্ত করেছে। 

বিধেয় পদের প্রসারণ মূলক উদাহরণ:

১। 
ক) মেয়েটি নাচে।

খ) মেয়েটি ঘুমুর পরে নাচে।

গ) মেয়েটি রোজ ঘুমুর পরে নাচে।

ঘ) মেয়েটি তবলার সাথে রোজ ঘুমুর পরে নাচে।

ঙ) মেয়েটি ঘরের মধ্যে তবলার সাথে রোজ ঘুমুর পরে নাচে।

২।
ক) রতন পরীক্ষায় ফেল করেছে।

খ) রতন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

গ) রতন ২০১৯ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

ঘ) রতন অল্পের জন্য ২০১৯ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে।

উপরে আলোচ্য উদাহরণ গুলিতে বিধেয় পদের অর্থকে পরিস্ফুট করার জন্য যে ক্রিয়া বিশেষণ গুলি বাক্যে যুক্ত হয়েছে, সেগুলি হল বিধেয় পদের প্রসারক।

দ্রষ্টব্য:

কোন কোন বাক্যে ক্রিয়ার অর্থ সম্পূর্ণ করার জন্য দু একটি অপরিহার্য পদ থাকে, যাকে বাদ দিলে বাক্যটির অর্থ অপূর্ণ থেকে যায়। যেমন: রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাক্যটিতে নোবেল পুরস্কার পদগুচ্ছ না থাকলে পেয়েছিলেন ক্রিয়াপদটি বা বিধেয় পদের অর্থ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এরকম যে পদ বিধেয় পদের অর্থ প্রকাশের জন্যে অপরিহার্য, তাকে বিধেয়র পরিপূরক পদ বলা হয়। উদ্ধৃত বাক্যটিতে নোবেল পুরস্কার বিধেয় পদের পরিপূরক পদ হিসেবে কাজ করছে। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাক্যে উদ্দেশ্য ও বিধেয় নানাভাবে নানা সংখ্যায় অবস্থান করতে পারে। নিম্নে সেই সকল অবস্থান গুলির উল্লেখপূর্বক উদাহরণ সহকারে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা হলো।

  • একটি উদ্দেশ্য একটিই বিধেয়: তপন পড়াচ্ছে। (এখানে তপন হলো উদ্দেশ্য এবং পড়াচ্ছে হলো বিধেয় পদ।)
  • একটি উদ্দেশ্যের অনেকগুলি বিধেয়: কুন্তল লেখাচ্ছে, বোঝাচ্ছে, শেখাচ্ছে এবং মূল বইটি পড়াচ্ছে।
  • একটি বিধেয়র অনেক উদ্দেশ্য: তপন, সুশান্ত, অরিত্র ও কুন্তলের পড়াশোনা অনেক।
  • উহ্য উদ্দেশ্য: কি গান শোনাবে? (উদ্ধৃত বাক্যটিতে প্রকৃত উদ্দেশ্য তুমি উহ্য রয়েছে।)
  • উহ্য বিধেয়: চলো মন নিজ নিকেতনে। ( উদ্ধৃত বাক্যটিতে প্রকৃত বিধেয় যাই বা যাবে লুপ্ত রয়েছে।) 

বাংলা ব্যাকরণে বাক্যের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় সম্পর্কে এই ছিল মোটামুটি সংক্ষিপ্ত ধারণা। আলোচ্য উপস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট বিষয় সব রকম প্রকারভেদ এবং উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্পর্কে মনে রাখার মত সকল দ্রষ্টব্য বিষয়কে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করা যায়, এই উপস্থাপনাটি পাঠের পর বাংলা ব্যাকরণের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে পাঠকের মনের সকল অন্ধকার দূর হয় একটি সার্বিক ধারণার বিকাশ ঘটবে। তবুও যদি আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে আপনাদের কোনো বক্তব্য থাকে, তবে তা নিচে মন্তব্যের মাধ্যমে বিশদে আমাদের জানান। আপনাদের মতামত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা চেষ্টা করব আপনাদের মতামত অনুযায়ী আমাদের লেখনীকে আরও উন্নত করে তোলার। তাছাড়া যদি এমনই অন্য কোন প্রতিবেদন পড়তে চান সে বিষয়েও আমাদের অবগত করুন। আমরা অতি সত্বর আবেদনগুলি বিবেচনা করে আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন