জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা প্রবন্ধ রচনা বা সংবাদপত্র রচনা [PDF]

সংবাদপত্র পড়ার উপকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বের ঘটে চলা সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হল সংবাদপত্র। সংবাদ পত্র পড়ার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি আগামী দিনের আবহাওয়া,জানতে পারি বিভিন্ন দেশের নতুন নতুন আবিষ্কার,জানতে পারি আমাদের গণতান্ত্রিক দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক খবর। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষদের মধ্যে জনমত গঠনে সংবাদপত্র কতখানি সক্ষম? সে নিয়েই আজকের বিষয় জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা প্রবন্ধ রচনা বা সংবাদপত্র রচনা।

জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা প্রবন্ধ রচনা বৈশিষ্ট্য চিত্র

ভূমিকা:

শিক্ষিত মানুষ মাত্রই আমরা সকলেই জানি বর্তমান যুগের বহুল প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্রের মোট তিনটি প্রধান স্তম্ভ। প্রথমটি হলো আইন বিভাগ, দ্বিতীয়টি শাসন বিভাগ এবং তৃতীয়টি বিচার বিভাগ। এই তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পারিক কর্মসামঞ্জস্য ও সহযোগিতার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

তবে বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা বা শক্তির মূল প্রতিভূ যে জনগণ,  উপরিউক্ত ওই তিনটি বিভাগ দ্বারা তাদের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন হয় আরো একটি অনন্যসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ মাধ্যমের।

সেটি হল সংবাদমাধ্যম। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শক্তির প্রধান উৎস সাধারণ জনগণের সঙ্গে নির্বাচিত শাসকগোষ্ঠীর সংযোগ রক্ষা করে বলেই হয়তো একে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। বর্তমান যুগে সংবাদ মাধ্যম বলতে বিভিন্ন ধরনের মাধ্যমকে বোঝানো হয়ে থাকলেও, এর আবির্ভাব লগ্নে প্রাথমিকভাবে সংবাদমাধ্যম বলতে মানুষ সংবাদপত্রকেই বুঝত।

আদর্শ সংবাদমাধ্যম ও সংবাদপত্র:

বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সংবাদমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের ভূমিকা সমাজে যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তেমনই এই অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে একটি আদর্শ সংবাদপত্রের সংজ্ঞা নিরূপণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কর্তব্য হয়ে পড়েছে। কারন বিশ্বব্যাপী সকল মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জনিত অবক্ষয় থেকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভও রক্ষা পায়নি।

সংবাদপত্রকে বর্তমানে বিভিন্ন রঙিন চশমা দিয়ে দেখলেও সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত রূপ আসলে সাদাকালো। বিশ্বব্যাপী সকল পরিসরে যে সমস্ত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, সাধারণ মানুষের কাছে নির্ভেজাল এবং পক্ষপাতহীনভাবে  উপস্থাপন করায় সংবাদপত্রের আদর্শ কর্তব্য। ঘটনার মধ্যে কোনটি ঠিক কিংবা কোনটি ভুল তা বিচার করা সংবাদপত্রের কাজ নয়। যে ঘটনা যেমনভাবে ঘটেছে ঠিক তেমন ভাবে তাকে জনমানুষের কাছে উত্থাপন করাই সংবাদপত্রের কাজ। 

জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ইতিহাস:

সংবাদপত্রের প্রকৃত ইতিহাসকে খুঁজে পেতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অতীতের ইউরোপের রোমান সাম্রাজ্যে। রোমান সাম্রাজ্যে বিভিন্ন বার্তা মানুষের মধ্যে প্রচার ও প্রেরণের উদ্দেশ্যে পাথরের ফলকে লিখে রাজপথের বিভিন্ন দেয়ালে টানিয়ে দেওয়া হত। মনে করা হয় সেই ফলকসমূহই আজকের সংবাদপত্রের আদিমতম রূপ। এরপর মধ্য যুগে চীনদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার জন্য প্যাপিরাসের কাগজে হাতে লেখা বিভিন্ন পত্র প্রচার করা হতো।

মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে সুলতানি যুগে বিভিন্ন রাজনৈতিক নির্দেশনামা প্রচারের উদ্দেশ্যেও এই ধরনের পত্রের প্রচলন ছিল। এরপর ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ লগ্নে জেমস হিকির হাত ধরে শুরু হয় ভারতবর্ষের প্রথম পত্রিকা বেঙ্গল গেজেট। তারপর আধুনিক ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায় শুরু করেন সম্বাদ কৌমুদী নামক বাংলা পত্রিকা। এর পরবর্তী কাল থেকেই ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের গৌরবের যুগ শুরু হয়ে যায়।

পরাধীন ভারতে সংবাদপত্রের ভূমিকা:

ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশ শক্তির অধীন ছিল, তখন বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র গুলি সাধারণ ভারতীয় জনমানষে ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল। একদিকে তারা যেমন বিভিন্ন সরকারি শাসনগত ফরমান বা নির্দেশনামা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিত, তেমনি সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিজেদের সংবাদপত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করত।

এছাড়া বিভিন্ন সরকারি দমনমূলক তথা বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতেও সমকালীন এই সকল সংবাদপত্র গুলি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বেশকিছু সংবাদপত্র জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে এতোখানিই উদ্ভুদ্ধ করতো যে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সরকার ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট পাস করে এই সকল সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল।

তাছাড়া বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে যখন সমগ্র ভারত জুড়ে স্বদেশী তথা বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল, তখন প্রচলিত সংবাদপত্রগুলিই দেশব্যাপী বিদ্রোহ ও আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। 

সংবাদমাধ্যম ও সংবাদপত্রের বিবর্তন:

সময়ের সাথে সাথে বিশ্বের সকল কিছুই বদলে যেতে থাকে। সংবাদপত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। সেকারণে পরাধীন ভারতবর্ষের কিমা মধ্যযুগের বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের যে রূপ প্রচলিত ছিল, বর্তমানে তা আমূল বদলে গিয়েছে।

সেই অতীতকালে পাথরের ফলকে রাজ বার্তা লিখে দেওয়ালে টাঙানো থেকে, প্রাক মধ্যযুগীয় চীনে প্যাপিরাসের পাতায় রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা এবং আধুনিক যুগে জেমস হিকির বেঙ্গল গেজেট- যুগ যুগ ধরে এই সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সংবাদপত্র বর্তমান যুগের বিবর্তিত রূপে এসে পৌঁছেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে এবং বিশেষ করে আশির দশকের পরবর্তী সময় থেকেই ভারতীয় সংবাদপত্র বিশেষভাবে বদলে যেতে শুরু করেছে।

বর্তমান যুগের সংবাদপত্র:

বর্তমান যুগের সংবাদপত্রের সঙ্গে ভারতবর্ষের শুরু হওয়া প্রথম সংবাদপত্রটির ন্যূনতম মিলও খুঁজে পাওয়া যায় না। আধুনিক যুগে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিশ্বায়নের ছোঁয়া থেকে রেহাই পায়নি সংবাদমাধ্যমও। বিশ্বায়নের সেই অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী বিবর্তিত হয়েছে হয়েছে সংবাদপত্রগুলিকেও।

আধুনিক সংবাদপত্রের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে সেই বিবর্তনের ছোঁয়া। বর্তমান সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় খবরের সাথে সাথে তাই চোখে পড়ে রংবেরঙের বিজ্ঞাপন; নির্ভেজাল ও পক্ষপাতহীনভাবে সত্য তুলে ধরার নীতি থেকে সরে এসে তাই বিভিন্ন সংবাদপত্রে ঘটনার তুলনায় রটনা বেশি প্রাধান্য পায়। তাছাড়া এখনো বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে পুরোপুরিভাবে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সংবাদপত্রগুলিতে পেশ করা খবরে তার প্রভাব বিশেষভাবে চোখে পড়ে। সেজন্যে আকারে ও বহরে বেড়ে গেলেও মানের দিক থেকে তুলনা করলে বর্তমান যুগের অধিকাংশ সংবাদপত্রই পূর্বতন আদর্শ সংবাদপত্রগুলির তুলনায় নিম্নমানের।

সমাজ সচেতনতার প্রসারে সংবাদপত্র:

সংবাদপত্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ঘটনার সংবাদকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে জনসচেতনতার প্রসারে এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটা বিভিন্ন বিপর্যয়ের সময়ে সংবাদপত্রের ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।

বিপর্যয়ের সময় কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কোনটি করা উচিত, কোনটি করা উচিত নয় ইত্যাদি তথ্যাবলী মানুষের কাছে তুলে ধরে সংবাদপত্রই। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাগত মাধ্যমের প্রচারের বিষয়েও সংবাদপত্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। ফলে সমাজ সচেতনতার প্রসার ঘটে।

সংবাদপত্রের বাজারিকরণ জনিত কুফল:

সংবাদপত্র হলো দৈনন্দিন মানুষের জীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান। বিশ্বব্যাপী বিশ্বায়নের প্রভাবে সেই উপাদানটির বাজারিকরণের ফলে শুধুমাত্র সংবাদপত্রের মানগত ক্ষেত্রেই নয়, জনসমাজের সাংস্কৃতিক মানসিকতার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন কুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সংবাদপত্র যেমন জনমত গঠনে সাহায্য করতে পারে, তেমন এই সংবাদপত্রই গঠিত জনমতকে বিভিন্ন অসামাজিক তথা অপসাস্কৃতিক কাজে পরিচালিত করতে পারে। সংবাদপত্র যেহেতু একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান, সে কারণেই জনমতও সংবাদমাধ্যমের এই ধরনের ভূমিকায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

এক সময় যে সংবাদপত্র সুসংস্কৃতি এবং সুসমাচার প্রচারের প্রতিভূ ছিল, বর্তমানে সেই সংবাদপত্রগুলিই সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার হীন খেলায় লিপ্ত হচ্ছে। ফলে প্রচার পাচ্ছে অপসংস্কৃতি, সুস্থ সমাজের প্রকৃত আত্মা উঠছে বিষিয়ে।

উপসংহার:

সংবাদপত্র হল একটি জাতির গঠনের পক্ষে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহায়ক উপাদান। সমাজে সংবাদপত্রের নির্ভরযোগ্যতা বিঘ্নিত হলে সামাজিক ঐক্যের ক্ষেত্রে তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। সংবাদপত্রই আধুনিক যুগের সেই পরম নির্ভরযোগ্য সার্বজনীন ধর্মগ্রন্থ যা সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি জীবননীতি বিষয়েও মানুষকে সচেতন করে এবং দিকনির্দেশনা দান করে।

সে কারণে সংবাদপত্রের যেকোনো সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে নির্ভেজাল এবং পক্ষপাতহীন থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া সংবাদপত্রই সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির প্রচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী হতে পারে। সে কারণে সংকীর্ণ বাজারি স্বার্থ চরিতার্থ করার বাসনা ত্যাগ করে আদর্শ সংবাদ পরিবেশনে আত্মনিয়োগ করাই সংবাদপত্রগুলির পরম কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। 


জনমত গঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা বা সংবাদপত্র প্রবন্ধ রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাবেন।আপনার একটি কমেন্ট আমাদের অনেক উৎসাহিত করে আরও ভালো ভালো লেখা আপনাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় জন্য।বানান ভুল থাকলে কমেন্ট করে জানিয়ে ঠিক করে দেওয়ার সুযোগ করে দিন।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন