সুখময় বসন্ত পেরিয়ে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে গ্রীষ্মের পদধ্বানি শোনা যায়। গ্রীষ্মকাল বললেই চারদিকের পরিবেশের যে রূপ মনে ভেসে ওঠে তা হলো গ্রীষ্মের নির্জন দুপুর, খাঁ খাঁ রোদ্দুর, ফাঁকা রাস্তা ইত্যাদি। গ্রীষ্মের দুপুরের প্রকৃতির রূপকে তুলে ধরে আমাদের আজকের উপস্থাপন একটি গ্রীষ্মের দুপুর রচনা।
সূচি তালিকা
ভূমিকা:
প্রতিবছরের সূচনালগ্নে ঋতুরাজ মধুর বসন্তের বিদায়ের শেষে আগমন ঘটে গ্রীষ্ম ঋতুর। এই গ্রীষ্মের মধ্যে দিয়েই আমরা নতুন বছরকে বরণ করে নিই সাদরে। সুখকর বসন্তের পর কঠোর বৈশাখের অনুভূতি তেমন মনোরম না হলেও একথা স্বীকার করতেই হয় যে গ্রীষ্ম ঋতু রুপের নানা বৈচিত্রে বৈচিত্র্যময়। সর্বোপরি প্রকৃতির কাছে এই গ্রীষ্মের দান অনেক।
নতুন ফসল ফলমূল-সবজি এমনকি জ্যৈষ্ঠের শেষে আষাঢ় শ্রাবনের বারিধারাও এই গ্রীষ্মেরই দান। বৈশাখের সকাল থেকেই মাথার ওপর জলন্ত সূর্য গ্রীষ্ম ঋতুর আগমনকে নিয়ত ঘোষণা করতে থাকে। সময় যতই এগিয়ে যায় ঋতুর কঠোরতা ততই যেন তীব্র হয়। এইভাবে ধীরে ধীরে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলে গ্রীষ্মের প্রকৃত রূপ ধরা পড়তে থাকে পৃথিবীর বুকে। এই সময় খরতপ্ত প্রকৃতি যেন স্নেহেরই আক্রোশে রুদ্র নৃত্য করতে থাকে। কবির ভাষায় যার রুপ-
“ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে
খাল বিল চৌচির জল নেই পুকুরে।
মাঠে ঘাটে লোক নেই খাঁ খাঁ রোদ্দুর
পিপাসায় পথিকের ছাতি কাঁপে দুদ্দুর।”
গ্রীষ্মের দুপুরের প্রাকৃতিক রূপ:
চৈত্র মাসের শেষদিকে নাগাদ অর্থাৎ বসন্ত তার বিদায় ঘোষণা করবার কিছুদিন আগে থেকেই যেন শোনা যেতে থাকে রুদ্র গ্রীষ্মের গম্ভীর পদধ্বনি। বসন্তের বাতাসে একটু একটু করে মিশতে থাকে কঠোরতার গন্ধ। বৈশাখের দুপুরে এর রূপ হয়ে ওঠে কঠিন, কঠোর ও রুদ্র। মধ্য গগনে বিরাজমান জলন্ত সূর্য তার সম্পূর্ণ তেজ উজাড় করে ঢেলে দেয় পৃথিবীর বুকে।
ছোট ছোট খাল-বিল নদী-নালা জল শুকিয়ে যায়, জলচর প্রাণীরা হয় বাস্তুহারা, নদীচর, মাঠ, পথঘাট অস্বচ্ছ দাবদাহে ফুটিফাটা হয়ে ওঠে। তার ওপর দুপুরবেলায় বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বইতে থাকে তীব্র গরম বাতাস। আবার কখনও কখনও গাছের পাতারা স্পন্দনহারা হয়। তখন সমগ্র প্রকৃতির ঘন নিস্তব্ধতায় নিঝুমতায় চারিপাশকে মনে হয় প্রাণহীন মৃতপ্রায়। এমতাবস্থায় সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি যেন অসীম পিপাসায় শান্তির বারিধারায় সিক্ত হবার নিমিত্ত অপেক্ষা করতে থাকে।
গ্রীষ্মের দুপুরে গ্রাম্য জীবন:
ভারতীয় উপমহাদেশ প্রধানত গ্রাম নির্ভর সভ্যতা। গান্ধীজী বলেছিলেন ভারতবর্ষের আত্মা বসবাস করে ভারতবর্ষের গ্রামে। সেই গ্রাম গ্রীষ্মের খরতাপে দুপুরের প্রখর দাবদাহে প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যে গ্রামের মানুষ চূড়ান্ত প্রানবন্ততায় নিজের কাজে যেত, ফসল ফলাত, মহিলারা ঢেঁকিতে ধান ভাঙতো, জেলেরা যেতো মাছ ধরতে সেই মানুষের জীবন গ্রীষ্মের করাল তাপে ঝিমিয়ে পড়ে।
গাছের পাতাগুলি নুইয়ে আসে, তৃষ্ণার্ত পাখিরা সামান্য জলের আশায় ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। সূর্যের তাপে ক্লান্ত শ্রান্ত পথিক আশ্রয় নেয় গাছের শীতল ছায়ায়। আর গৃহস্থরা মাটির ঘরে খড়ের চালার নিচে, মাটির কলসির শীতল জলে এবং হাতপাখার মৃদু বাতাসে প্রশান্তি খুঁজে নেয়।
গ্রীষ্মের দুপুরে কৃষকের জীবন:
ভারতবর্ষের সিংহভাগ গ্রামই সম্পূর্ণরূপে কৃষিনির্ভর। আর গ্রামের এই কৃষিনির্ভর সভ্যতা যাদের কাঁধে ভর দিয়ে চলে, সেইসব কৃষকেরাও গ্রীষ্মের খরতপ্ত দুপুরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবুও তাদের কাজে বিরাম থাকে না বললেই চলে।
গ্রামে গ্রামে গ্রীষ্মের দুপুরে আমরা দেখতে পাই তাপনিরোধী টেকো মাথায় অবিরাম কাজ করে চলেছে ভারতবর্ষের কৃষক। দুপুরের খরতাপে পবিত্র ঘামে সিক্ত হয়ে তারা ফসল ফলিয়ে চলেছে। কখনো বা চোখে পড়ে বিস্তৃত প্রান্তর কিংবা ক্ষেতের মাঝখানে কোন এক বৃহৎ বৃক্ষের নিচে পরিশ্রান্ত কৃষক কয়েক মুহুর্ত বিশ্রাম নিচ্ছেন।
শহরাঞ্চলে গ্রীষ্মের দুপুর:
গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে গ্রীষ্মের দুপুরের রুদ্র রূপ তুলনামূলকভাবে বেশি কঠোর। এর পিছনে থাকা বিবিধ কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো শহরাঞ্চলে বৃক্ষরাজির অপ্রতুলতা, যথেষ্ট পরিমাণ জলাভূমির অভাব, কলকারখানার প্রাচুর্য এবং তার ফলে ক্রমবর্ধমান দূষণ। এই সকল উপাদান মিলে শহরাঞ্চলে গ্রীষ্মের রূপকে আরো অসহ্যকর করে তোলে।
যদিও শহরাঞ্চলের আধুনিক সভ্যতা গ্রীষ্মের এই কঠোরতা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে নানা আধুনিক কৃত্তিম উপায় অবলম্বন করে থাকে। পথের কর্মব্যস্ত মানুষ দুপুরের গরম থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে গলা ভেজায় ঠান্ডা শরবত কিংবা নরম পানীয় দ্বারা। আর অফিস কিংবা বাড়িতে মানুষ স্বস্তি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে কৃত্রিম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে।
স্কুল-কলেজের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বন্ধ হয়ে যায়। কর্মব্যস্ত ক্লান্ত শহরের গতি হয়ে ওঠে তুলনামূলকভাবে মন্থর। তবু গ্রীষ্মের দুপুরের রোদ যতই প্রখর হোক না কেন শহরের জীবনযাত্রা কখনো স্তব্ধ হয়ে যায় না; বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ দুপুরের রুদ্রনৃত্যও শহরাঞ্চলে আধুনিকতার চাকাকে রুদ্ধ করতে পারেনা।
শ্রমিকের গ্রীষ্মকাল:
গ্রামের কৃষকের মতই শহরের শ্রমিকের কাছেও গ্রীষ্মের দুপুর মোটেই সুখকর নয় বরং আরো বেশি কষ্টের। শহরের ঝাঁ-চকচকে ব্যস্ত সন্ত্রস্ত জীবনের আড়ালে পড়ে থাকে শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম। গ্রীষ্মের দুপুরের বীভৎস গরমেও এই মানুষেরা সামান্যতম বিরাম পায় না। গ্রীষ্মকালের দুপুরে কলকারখানার মধ্যে বদ্ধ কর্মজীবন এই সকল শ্রমিকের কাছে ব্লাস্ট ফার্নেসের সমতুল্য হয়ে ওঠে।
সব সময় শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যকরও থাকেনা। নির্মম পরিবেশ এবং অসহ্য পরিশ্রমের ফলে শ্রমিকদের শরীরে অচিরেই দানা বাঁধে নানা রোগ। কৃষক ও শ্রমিক এরা আমাদের সমাজের অন্যতম প্রধান দুই স্তম্ভ। তাই প্রকৃতি যতই রুদ্র রূপ ধারণ করুক না কেন আমাদের সব সময় এই দুই স্তম্ভের যথাযথ খেয়াল রাখতে হবে।
গ্রীষ্মের দুপুর ও বিবিধ কর্মজীবন:
তবে কৃষক ও শ্রমিকের বাইরেও সমাজের এক বিস্তৃত কর্মজগৎ রয়েছে। এই জগতের সাথে জড়িত মানুষের জীবনও গ্রীষ্মের দুপুরের ব্যাপক দাবদাহে বিশেষ প্রভাবিত হয়। সকলের মতো তারাও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ রুদ্রমূর্তিতে বিহ্বল হয়ে পড়ে। সকলের মতো তাদের শরীরও শুষ্ক ও তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে।
পথের ফেরিওয়ালা এই দুপুরে আশ্রয় নেয় পথেরই কোন ছায়ায়। গৃহবধূরা ঘরের সকল কাজ সেরে ক্লান্ত শরীরে বিশ্রাম করেন। অফিস কাছারির সাথে জড়িত মানুষেরা গ্রীষ্মের খরতপ্ত মধ্যাহ্নেও দুপুরের টিফিন ছেড়ে অবিরাম কাজে ব্যস্ত থাকেন। স্কুল-কলেজের মতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি ছুটি থাকার কারণে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বাড়িতে কিংবা কোন মনোরম স্থানে ছুটি কাটিয়ে থাকেন।
কালবৈশাখী:
বাংলায় গ্রীষ্মকালের দুপুরের এক অতি পরিচিত অনিবার্য রূপ হল হঠাৎ ঝড়, যাকে আমরা কালবৈশাখী বলে জানি। গ্রীষ্মের অসহ্য গরমে পৃথিবী যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত, তখন প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে আকাশ জুড়ে ঘনিয়ে আসে ঘন ধূসর মেঘ, দুরের প্রান্তর হতে বয়ে আসে শীতল ঝড়ো হাওয়া, আর সবশেষে ধরিত্রীর বুকে প্রকৃতির অঞ্জলি রূপে নেমে আসে শীতল বারিধারা।
গ্রীষ্মের খরতপ্ত দুপুরে শুষ্ক তৃষ্ণার্ত পৃথিবী প্রাণ ফিরে পায়। গাছের সবুজ পাতাগুলি সতেজতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে, পাখিকুল নেচে ওঠে তৃষ্ণাপূর্তির আনন্দে। ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষ জ্বালাময়ী খরতপ্ত সূর্য থেকে মুহূর্তের মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। আর অন্যদিকে গ্রামের কৃষকরা পরম আনন্দে মাঠ ক্ষেত জুড়ে ছড়িয়ে দেয় শস্যের বীজ। আম গাছের মুকুল থেকে সদ্য বেরোনো ছোট ছোট আমগুলি এই শীতল মুষলধারায় প্রকৃতি থেকে পুষ্টির নির্যাস শোষণ করে ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে ওঠে।
গ্রীষ্মের দুপুর এবং বঙ্গ সংস্কৃতি:
গ্রীষ্মের দুপুরের রূপ যতই কঠোর ও কঠিন হোক না কেন, তা সরাসরি বাংলার সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি এই প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় বাংলার গ্রামাঞ্চলে। গ্রীষ্মের দুপুরে বাংলার গ্রামে গ্রামে ক্লান্ত শ্রান্ত পথিক যখন গাছের ছায়ায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তখন একসাথে অনেকের সমাগমে জমে ওঠে আড্ডা, গড়ে ওঠে মানুষে-মানুষে সামাজিক বন্ধন।
অন্যদিকে গ্রীষ্মের করাল রূপ থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য বাংলার গ্রামাঞ্চলে প্রচলন রয়েছে পান্তা খাওয়ার। এই পান্তা খাওয়াকে কেন্দ্র করেও মূলত কৃষকদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক মধুর সংস্কৃতি যা পূর্ণতা পায় স্থানীয় উৎসবে। গ্রামের বিভিন্ন একান্নবর্তী পরিবারে গ্রীষ্মের দুপুরে গৃহবধূরা ঘরের সকল কাজ সেরে যখন একসাথে হয় তখন তাদের সমবেত প্রচেষ্টার মধ্যে পরিপূর্ণতা পায় বড়ি দেওয়া, আচার বানানো, আমসত্ত্ব দেওয়া, ইত্যাদি বাংলার সুমধুর গ্রামীণ সংস্কৃতিগুলি।
দুপুরে অবসর যাপনের কালে বাংলার গ্রামের ঘরে ঘরে বিভিন্ন গৃহবধূরা কাপড়ের উপর নানা রকমের দৃষ্টিনন্দন নকশা সেলাই করে, বিভিন্ন গ্রামীণ উপজাতির মানুষেরা এই সময়ে দেওয়ালে, মাটির খুরির উপরে, এমনকি কাপড়ের গায়ে ফুটিয়ে তোলে নানা রকমের সুন্দর চিত্রকলা। এই ধরনের চিত্রকলা বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও অর্জন করেছে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে গ্রীষ্মের দুপুরে দু’দণ্ড স্বস্তি খুঁজে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষ ভিড় জমায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত বিভিন্ন শপিং মল, সিনেমা হলে।
উপসংহার:
গ্রীষ্মের দুপুর আমাদের কাছে এই পৃথিবীর এক বিচিত্র রূপ তুলে ধরে। জলন্ত সূর্যের খরতপ্ত রুদ্র রূপ এই দুপুরের মধ্যে বর্তমান থাকলেও, কোথাও গিয়ে যেন গ্রীষ্মের দুপুরের নিজস্ব এক প্রাণময় চরিত্র রয়েছে। এই দুপুর যেন আমাদের বুঝিয়ে দেয় ক্লান্ত, শ্রান্ত বিশ্বপ্রকৃতির স্তব্ধতা এবং নিঝুমতাও দিনের অন্যান্য সময়ের মতন সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
তৃষ্ণার্ত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েও একদিক থেকে যেমন গ্রীষ্মের দুপুর বাংলার সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে, অন্যদিকে তেমন গ্রীষ্মের দাবদাহই পরবর্তীর বর্ষাকে আবাহন করে আনে। তাইতো গ্রীষ্মকালের শেষ হতে না হতেই আকাশের বুকে গুরুগম্ভীর মাদল বাজিয়ে বর্ষা ঘোষণা করে তার আগমন। এমনভাবেই মহাকালের নিয়মে গ্রীষ্মের দুপুর মানুষের কাছে উপেক্ষিত হয়ে নত মস্তকে মলিন মুখে বিদায় নেয়।
“গ্রীষ্মের দুপুর” রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন:
শীতের সকাল রচনা